প্রথম চিকিৎসক হিসেবে চমেকের ডাক্তার বাবর আলীর এভারেস্ট জয়

এভারেস্ট সামিটের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই বিশ্বের চতুর্থ শীর্ষ শৃঙ্গ লোৎসে জয় করেছেন ডা. বাবর আলী। আজ মঙ্গলবার নেপালের স্থানীয় সময় ৫টা ৫০ মিনিটে লোৎসে চূড়ায় ওঠেন। এটিই বাংলাদেশের প্রথম লোটসে সামিট। এ ছাড়া দেশের কারো পক্ষে একই অভিযানে দু’টি আট হাজারিশৃঙ্গ সামিটের ঘটনাও এটিই প্রথম।

এর আগে রোববার (১৯ মে) নেপালের স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে আটটায় এভারেস্ট চূড়ায় বাংলাদেশের লাল সবুজের পতাকা ওড়ান চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ৫১তম ব্যাচের এই শিক্ষার্থী।

৪৮ ঘণ্টার ব্যবধানে আটহাজারি দু’টি শৃঙ্গ জয়ের খবর দিয়ে ডা. বাবর আলীর ক্লাব ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে লিখেছে,‘বাংলাদেশের পর্বতারোহণের ইতিহাসে আজ লিখিত হলো অভূতপূর্ব ও রোমাঞ্চকর এক অধ্যায়। আর লেখক আমাদের স্বপ্ন সারথি বাবর আলী। আজ নেপালের স্থানীয় সময় ভোর ৫টা ৫০ (বাংলাদেশ সময় ৬টা ৫) মিনিটে বাবর দাঁড়ালো বিশ্বের চতুর্থ শীর্ষ শৃঙ্গ লোৎসে চূড়াতে। আজ তিন দিন ধরে রুদ্ধশ্বাস প্রতীক্ষার হলো অবসান। আমরাও পারি! আমাদের দিয়েও সম্ভব।’

এতে আরো লেখা হয়, ‘এটিই এই বাংলাদেশের কোন সন্তানের প্রথম লোৎসে সামিট এবং প্রথম একই অভিযানে দুইটি আটহাজারি শৃঙ্গ সামিট। এই জাতি অন্তত একটা দিন আনন্দে মাতুক। তবে ভুললে চলবে না বাবর এখন নেমে আসা শুরু করেছে। এবং বেসক্যাম্পে পৌঁছালেই হবে মূল উৎসব।’

৫ম বাংলাদেশি এভারেস্টজয়ী ডা. বাবর আলী পড়াশোনা শেষে যোগ দিয়েছিলেন জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তা হিসাবে। কিন্তু পরে সব ছেড়ে-ছুঁড়ে মনোযোগী হন পর্বতারোহণসহ নানা দুঃসাহসিক অভিযানের দিকে। তার গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার হালদা পাড়ের বুড়িশ্চর এলাকায়। দেশ ভ্রমণের গল্প নিয়ে ‘পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা’ এবং ‘সাইকেলের সওয়ারি’ নামে ডা. বাবরের দু’টি মৌলিক গ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছে। অনুবাদ করেছেন ‘ম্যালরি ও এভারেস্ট’ গ্রন্থটি।

নেপালের স্নোয়ি হরাইজন নামক প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত অভিযানে এই সামিটে বাবরের সাথে ছিলেন তার দীর্ঘদিনের বন্ধু এবং পর্বতারোহণ গাইড বীর বাহাদুর তামাং। যাতে মূল পৃষ্ঠপোষক হিসেবে আছে ভিজ্যুয়াল নীটওয়্যার লিমিটেড। এ ছাড়া সার্বিক সমন্বয়ে রয়েছে বাবর আলীর নিজের ক্লাব ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স। অভিযানে মোট খরচ হচ্ছে ৪৫ লাখ টাকা।

এর আগে এভারেস্ট সামিটের পর অভিযানের প্রধান সমন্বয়ক ফরহান জামান জানিয়েছিলেন, গত ১ এপ্রিল নেপালের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলেন বাবর আলী। ৪ এপ্রিল কাঠমান্ডু থেকে উড়ে যান পৃথিবীর অন্যতম বিপজ্জনক বিমানবন্দর লুকলাতে। ১০ এপ্রিল বাবর পৌঁছে যান এভারেস্ট বেসক্যাম্পে। কিন্তু কয়েকদিন অপেক্ষার পরও নেপালের দায়িত্বরত দল পথ তৈরি করতে পারেনি। তাই বাবর বিকল্প বেছে নেন। ১৬ এপ্রিল সামিট করেন ২০ হাজার ৭৫ ফুট উচ্চতার লবুচে ইস্ট পর্বতে। এরপর আবারো বেসক্যাম্পে ফিরে আসেন। এ সময়ে পর্বতের নিচ অংশের পথ খুলে গেলে ২৬ এপ্রিল বেসক্যাম্প থেকে যাত্রা শুরু করে ক্যাম্প-২ পর্যন্ত ঘুরে এসে শেষ করেন উচ্চতার সাথে মানিয়ে নেওয়ার পর্ব। এরপর শুরু হয় দীর্ঘ অপেক্ষা।

এমন সময় আবহাওয়াবিদ মোস্তফা কামাল পলাশের কাছ থেকে পাওয়া যায় সুখবর। ১৯ হতে ২১ মে চুড়ার পরিবেশ কিছুটা শান্ত থাকবে। এরপরই ১৪ মে মাঝরাতে বেসক্যাম্প থেকে শুরু হয় বাবরের স্বপ্নের পথে যাত্রা। প্রথম দিনেই সরাসরি উঠে আসেন ক্যাম্প-২ এ, যার উচ্চতা ২১ হাজার ৩০০ ফুট। পরিকল্পনা অনুসারে সেখানে দুইরাত কাটিয়ে বাবর ১৭ মে উঠে আসেন ২৪ হাজার ৫০০ ফুট উচ্চতার ক্যাম্প-৩ এবং ১৮ মে আসেন ক্যাম্প-৪। ২৬ হাজার ফুট উচ্চতার এই ক্যাম্পের উপরের অংশকে বলা হয় ডেথ জোন। এদিন মাঝরাতে আবারো শুরু হয় বাবরের যাত্রা। ১৯ মের ভোরের প্রথম কিরণে ২৯ হাজার ৩১ ফুট উচ্চতার মাউন্ট এভারেস্ট শীর্ষে উড়িয়ে দেয় বাংলাদেশের পতাকা।

ওই সময় তিনি জানান, ‘অভিযান এখনো শেষ নয়! বাবরের আসল লক্ষ্য শুধু এভারেস্ট নয়, সাথে লাগোয়া পৃথিবীর চতুর্থ শীর্ষ পর্বত লোৎসেও। আজ ক্যাম্প-৪ এ নেমে মাঝরাতে আবারো শুরু করবেন দ্বিতীয় লক্ষ্যের পথে যাত্রা এবং সব অনুকুলে থাকলে ভোরে পৌঁছে যাবেন এর চুড়ায়। উল্লেখ্য যে এই লোৎসেতে ইতোপূর্বে কোন বাংলাদেশি সামিট করেননি এবং কোন বাংলাদেশি একই অভিযানে দু’টি আট হাজারী শৃঙ্গ চড়েননি। তাই লক্ষ্য পূরণ হলে বাবর আলী করবেন এই বিপদজনক খেলায় বাংলাদেশের ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা।’

তিনি বলেন, ‘বাবর আলীর এই সাফল্য শুধু তার ব্যক্তিগত অর্জন নয়, বরং এটি পুরো বাংলাদেশের জন্য এক গর্বের বিষয়। এটি আমাদের দেশের তরুণদেরকে আরও বড় স্বপ্ন দেখার এবং সেগুলি পূরণ করার জন্য অনুপ্রাণিত করবে। এই অভিযানের পেছনে ছিল অসংখ্য মানুষের অবদান এবং স্বপ্ন। আমরা তাদের সকলকে ধন্যবাদ জানাই।’

আজ থেকে ১০ বছর আগে চিকিৎসক বাবরের এই অধ্যাবসায়ের সূচনা। ২০১৪ সালে পর্বতারোহণ ক্লাব ভার্টিকাল ড্রিমার্স প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সতীর্থদের সাথে নিয়ে নেপাল এবং ভারতের বহু পর্বতে অভিযান করেছেন তিনি। প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে তিনি সামিট করেছেন নেপালের আমা দাবলাম পর্বত। পর্বতারোহণ তার নেশা হলেও সাইক্লিং, ম্যারাথন, স্কুবা ডাইভিংয়ের মতো অ্যাডভেঞ্চার এক্টিভিটিতেও নিয়মিত জড়িত ছিলেন। অ্যাডভেঞ্চারের তাড়নায় পায়ে হেঁটে ঘুরেছেন দেশের ৬৪ জেলা, সাইকেলে পাড়ি দিয়েছেন ভারতের কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারীর পথ। বান্দরবান থেকে হিমালয়, সুন্দরবন থেকে দক্ষিণ ভারত, যে জনপদেই তিনি গেছেন, সাক্ষী হয়েছেন অভূতপূর্ব কিছু মুহূর্তের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *